রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ০৪:২২ অপরাহ্ন
কবি হেলাল হাফিজ ছিল সংগ্রামী ও প্রতিবাদী কবি। কবি সারা জীবনই কবিজীবন যাপন করে গেছেন। কবিতার যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে চিরকুমারের জীবনে থেকেছেন। ব্যক্তি জীবনকে বৈষয়িকতা থেকে দূরে রেখেছেন। কবিতাকে ভালোবেসেছেন সবকিছুর চেয়ে বেশি। কোনো খ্যাতির পেছনে তিনি ছোটেননি, ছোটেননি কোনো প্রাপ্তির পেছনেও। কিন্তু, তিনি সবই পেয়েছেন। বলা যায়, যা পেয়েছেন তা আরও বেশিকিছু। পাঠক তাকে যে সম্মান দিয়েছেন- তা যে কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তির চেয়ে বেশিকিছু। কবি হওয়ার মোহ তার ছিল না। ছিল কবির যন্ত্রণা, যা প্রকৃত কবি মাত্রেই থাকে। হেলাল হাফিজ সেই বিরল প্রকৃতির কবিদেরই একজন। তার কবিতার পঙ্ক্তিতে জীবন নিংড়ানো সত্য উঠে এসেছে। আসাটাই স্বাভাবিক। কেননা তিনি নিজের জীবনটা মেলে ধরেছেন জীবন বোঝার শর্তের প্রতিটি প্রান্তরে। জীবনকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়ে কুড়িয়ে আনা কতটা কষ্টের তা আমরা হেলাল হাফিজের কবিতা পড়লেই বুঝতে পারি। তিনি লিখেছেন-
‘কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন-
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।’
অথবা
‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’
খুব দীর্ঘ আর গভীর অনুভূতি সঞ্চিত না হলে এমন কথা বলা যায় না। যে কথার ওজন ঠিক ওই আকাশ আর মাটির মধ্যের দূরত্বের সমান। হেলাল হাফিজ জীবনকে আঙুলের ডগায় এনে দেখেছেন। আবার দেখেছেন সমস্ত আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যে কারণে তিনি লিখতে পারেন-
‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছ’ এবং ‘নিউটন বোমা বোঝে, মানুষ বোঝে না!’র মতো হিরক পঙ্ক্তি।
এই কবি বাংলাসাহিত্যে তার কবিতা, কাব্য বিশ্বাস এবং কাব্য সংযমের জন্য বিশেষভাবে আলোচিত হবেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে লেখা তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের কবিতা ওই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই একটি কবিতা লিখেই বলতে গেলে কবিখ্যাতি তিনি পেয়ে যান। সেই সময়ের আন্দোলনের স্লোগানে তার এই কবিতার পঙ্ক্তি ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো। তখন এত খ্যাতি পেয়েও নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলেন। সেই সময়ে যে কবি হিসেবে বিখ্যাত, সবার কাছে পরিচিত- তার বই বের হল এসে ১৯৮৬ সালে।
কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং পাঠকের প্রতি অসম্ভব সম্মান না থাকলে কোনো কবি এতটা সংযমী হতে পারেন না। তরুণ বয়সে খ্যাতির মোহ তাকে তার কাব্য বিশ্বাস থেকে টলাতে পারেনি। তিনি যখন মনে করেছেন বই হওয়া দরকার- ঠিক তখনই তিনি বইয়ে গেলেন। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়টিও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে অনেক বছর। হেলাল হাফিজ কম লিখলেও তিনি কবিতার সঙ্গে কম ছিলেন না। সব সময়ই তার কবি মানসটি সজাগ ছিল। তার প্রমাণ আমরা পাই তার রাজনৈতিক কবিতাগুলো থেকে। এ দেশের পাঠক মহলে হেলাল হাফিজ প্রেম এবং বিরহের কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। অথচ তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের কবিতায় আমরা যেমন রাজনৈতিক সচেতনতা দেখতে পাই, তেমনি দেখতে পাই গভীর দেশপ্রেমের শাবলীল প্রকাশ। এই কবিতাটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতাটি উল্লেখ করছি-
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
……………………………………………………….
………………………………………………………
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।
……………………………………………………….
………………………………………………………
আমার উদ্দেশ্য হেলাল হাফিজের কবিতার আলোচনা না। উদ্দেশ্য হেলাল হাফিজের কবিতা নিয়ে লেখা পশ্চিমবঙ্গের উল্লাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘রেটিনার লোনা জলে উত্তরাধিকার’ গ্রন্থটির খবর জানানো। হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যে যতটা জনপ্রিয় কবি- তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় কবি। তার কবিতায় যে সব জীবন দর্শন উপস্থিত- তা এ দেশীয় মানুষের নিজস্ব আবেগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই কবিকে নিয়ে এই দেশের গবেষকশ্রেণীর তেমন উল্লেখ করার মতো কাজ নেই। হেলাল হাফিজের কবিতা জনপ্রিয়। কিন্তু এই কবিতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরার কাজটি এখানে অনেকেই এড়িয়ে গেছে।
কামরুন্নাহার কলি
উপ-বিভাগীয় সম্পাদক, সাহিত্য বিভাগ
একুশে টাইমস্ বিডিডটকম